শ্রেণীকক্ষে ছিল না শিক্ষকের চেয়ার-ফ্যান,শিক্ষার্থীদের রোরখা-হিজাবে আপত্তি প্রধান শিক্ষকের

শ্রেণীকক্ষের চারিদিকে ফ্যান থাকলেও শিক্ষকের মাথার উপর থেকে খুলে রাখা হয় বৈদ্যুতিক ফ্যান।

শ্রেণীকক্ষে ছিল না শিক্ষকের চেয়ার-ফ্যান,শিক্ষার্থীদের রোরখা-হিজাবে আপত্তি প্রধান শিক্ষকের

ক্রাইম রিপোর্টার চাঁপাইনবাবগঞ্জ:শ্রেণীকক্ষের চারিদিকে ফ্যান থাকলেও শিক্ষকের মাথার উপর থেকে খুলে রাখা হয় বৈদ্যুতিক ফ্যান। পাশাপাশি শিক্ষক যেন বসে ক্লাস না নিতে পারেন, তাই উঠিয়ে নেয়া হয় শিক্ষকের চেয়ার। আরামদায়ক না করে শিক্ষকদের ক্লাসকে আরো তথাকথিত কার্যকরী করার নামে এমন বর্বরতার অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রীণ ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদের বিরুদ্ধে। এমনকি ছাত্রীদের বোরখা-হিজাবেও আপত্তির অভিযোগ শিক্ষকদের। 

নিয়োগ কার্যক্রমকে অবৈধ ও বিগত দিনে আ.লীগের প্রভাব খাটানোর কথা উল্লেখ করে শ্রেণীকক্ষে ফ্যান খুলে নেয়া, চেয়ার সরিয়ে নেয়া, হিজাব-বোরখায় আপত্তি জানানো, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদকে পুর্নবহাল না করতে আবেদন করেছেন গ্রীণ ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৭ শিক্ষক। গত ০৭ নভেম্বর তারা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর তারা এই লিখিত অভিযোগ করেন। পাশাপাশি অভিযোগ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসককেও। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষকরা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ দায়িত্ব পালনকালে দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রাখতেন। তার দুর্ব্যবহার ছিল মাত্রাতিরিক্ত ও বর্ণনাতীত। শিক্ষক-স্বল্পতার জন্য গ্রিন ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিদিন ৬টা বা ৭টা ক্লাসের সব কয়টা করতে হতো। এমনকি শ্রেণিকক্ষ থেকে চেয়ার সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, যা শিক্ষকদের জন্য ছিল অবর্ণনীয় কষ্টকর। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে বেলা ২ট ১৫ মিনিট পর্যন্ত একটানা দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতে বাধ্য করেছিলেন। প্রচন্ড গরমে শিক্ষকের মাথার উপরে থাকা ফ্যানগুলো খুলে নিয়েছিলেন, যা ছিল চরম অমানবিকতা। 

অভিযোগকারী শিক্ষকরা বলেন, তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারতো না। কারন সবসময়ই তিনি প্রশাসন ও চাকুরিচ্যুত করার ভয় দেখাতেন। যা শিক্ষকদের প্রতি মুহূর্তে আতংকের মধ্যে রাখতো। শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহারের কারনে সাবেক জেলা প্রশাসক সরদার সরাফাত আলী একটি সভায় তাকে চরমভাবে ভৎর্সনা করেন। ফলে তিনি সভা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। খন্ডকালীন শিক্ষকদেরকেও বেতন না দিয়ে বৈষম্য করে রেখেছিলেন রোকসানা আহমদ। অর্থ সংকটের অযুহাতে খন্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি না করলেও তার অব্যহতি নেয়ার পর অর্থ কমিটি হিসাব করে দেখতে পায়, খণ্ডকালীন শিক্ষকবৃন্দকে নিয়মিতকরণের আর্থিক সঙ্গতি স্কুলের রয়েছে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রোকসানা আহমেদ বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের বোরকা পরার বিষয়ে তার তীব্র আপত্তি ছিল এবং বোরকা পরার জন্য তিনি মেয়ে শিক্ষার্থীদের ভৎর্সনা করে মাদ্রাসায় ভর্তির পরামর্শ দিতেন। বোরকার মতো মেয়ে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার বিষয়েও চরম বিরক্তি প্রকাশ করে নিরুৎসাহিত করতেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য নামাজের স্থানের বিষয়ে তিনি ছিলেন চরম উদাসীন, যা নামাজ আদায়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা ছিল।

শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছিলেন রোকসানা আহমেদ। গ্রীণ ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ড্রেস কর্নার থেকে উচ্চমূল্যে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফরম ও অ্যাপুলেট কিনতে বাধ্য করতেন। ২০ টাকার অ্যাপুলেট একশ টাকায় কিনতে বাধ্য করা হতো। রোকসানা আহমেদ অবসর নেয়ার পর ১০০ টাকা করে বিক্রি করা অ্যাপুলেট আবারো ২০ টাকায় বিক্রি চলছে। পাশাপাশি প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষার পরে স্কুলে কোচিং করতে বাধ্য করা হতো। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কালেক্টরেট চত্বরে অবস্থিত কালেক্টরেট গ্রিন ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে কোনো লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ও আইসিটি ল্যাব ছিল না। এসব না করে তিনি নিজের পকেট গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। 

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গ্রীণ ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৭ জন শিক্ষক মিলেই এসব অভিযোগ করেছেন। তারা অভিযোগ করেন, স্বেচ্ছায় অব্যহতি গ্রহণ করা প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমদ গ্রীন ভিউ স্কুলে ২০০১ সালে নিয়োগ পান কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষক হিসেবে। ২০০৩ সালে নিম্ন মাধ্যমিক শাখায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ তার চাইতে বেশি বেতনে যোগদান করেন। পরবর্তীতে প্রাথমিক শাখায় কর্মরত শিক্ষকবৃন্দের বেতন বৃদ্ধি হলেও রোকসানা আহমদের বেতন মাধ্যমিক শাখায় কর্মরত শিক্ষকের বেতনের চাইতেও কম থাকে। তিনি মাধ্যমিক শাখায় নিয়োগ প্রাপ্ত হলে বেতনের এমন বৈষম্য থাকার কথা নয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের বিধি অনুসারে হয় নাই, যা তার প্রধান শিক্ষকের পদে থাকার অযোগ্যতা প্রমাণ করে।

পাশাপাশি প্রাথমিক শাখার দুজন সিনিয়র শিক্ষক রোকসানা আহমদকে মাধ্যমিক শাখায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের যৌক্তিকতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি চলমান থাকা অবস্থায় বাদীরা চাকুরী হতে অবসরে যান। বাদীদের একজন ক্যান্সার-এ আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে বাদীদেরকে মামলা পরিচালনার পুরো অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে মামলাটি আপোষ মিমাংসা করেন এবং মামলাটি প্রত্যাহার করিয়ে নেন। এমনকি মামলা পরিচালনার সকল অর্থ স্কুলের তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়। 

বর্তমান শিক্ষকদের অভিযোগ, মামলা চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয় প্রায় ১ মাস প্রধান শিক্ষকবিহীন অবস্থায় থাকে। এসময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক পরবর্তী সিনিয়র শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের নির্দেশ দিলেও তা না করে স্কুল প্রধান শিক্ষক বিহীন রাখেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ। সেসময় তিনি শিক্ষার্থীদের বোর্ড রেজিষ্ট্রেশনে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরের স্থলে অফিস সহকারী স্বাক্ষর প্রদান করেন যা আইনের সম্পূর্ণ লংঘন। 

এবিষয়ে কালেক্টরেট গ্রীণ ভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগগুলো নিয়ে এই মুহুর্তে কথা বলা উচিত নয়। কারন তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের তদন্তকাজ করছে। আশা করি, সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন, গত ২১ আগষ্ট স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ। তিনি বলেন, সকল অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটিকে যথাযথ প্রমাণসহ আমার বক্তব্য প্রদান করেছি। শ্রেণীকক্ষে ফ্যান ও চেয়ার সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশিরভাগ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের মাথার উপরে ফ্যান লাগানোর সুযোগ ছিল না। এখন হুক লাগিয়ে ফ্যান দেয়া হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। ষড়যন্ত্র করে জোরপূর্বক স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করানো হয়েছিল বলেও দাবি করেন, রোকসানা আহমেদ। 

তদন্ত কমিটির প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, তদন্তকাজ শেষ হয়েছে। শীগ্রই জেলা প্রশাসনকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সরেজমিনে তদন্তে যা পাওয়া গেছে, প্রতিবেদনে তাই উল্লেখ থাকবে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবিষয়ে জেলা প্রশাসন সীধান্ত নিবেন বলেও জানান তিনি।