নওগাঁয় ঠিকানা বিহীন নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের কাছে এক স্বপ্নচুড়া
এবিএস রতন স্টাফ রিপোর্টার নওগাঁ :বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, শিক্ষার্থীদের কাছে এক স্বপ্নচুড়া। যে চুড়ায় দাড়িয়ে তিলতিল করে গড়া স্বপ্নের সারথীগুলো ডানামেলে উড়তে পারে। সেখানে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া সহজে কারো ভাগ্যে যেমন জোটে না, ঠিক তেমনি কোনো জেলাবাসীর ভাগ্যেও জোটেনা বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া। অথচ দুই বছর আগে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পাওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় নওগাঁবাসীর কপালে জোটার পরও স্থান ও নাম নির্বাচন নিয়ে শুরু হয় টানা হেঁচড়া। যার কারণে আজও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী অবকাঠামো।
কৃষি প্রধান দেশের ধানের রাজ্য ও শষ্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ বিল পাস হয়ে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়। তবে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে স্থান নির্ধারণ। কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়টির নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস। শুরু হয়নি একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম। উপাচার্য (ভিসি) ও কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়া নেই কোনো অগ্রগতি। তবে নওগাঁবাসী ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজ দ্রুত শুরু করতে চান নব-নিযুক্ত উপাচার্য (ভিসি)।
জানা যায়, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নওগাঁয় এক জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নওগাঁ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম নেতা আব্দুল মালেক একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নওগাঁয় একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
এর চার বছর পর ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত বিলের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। একই বছরের ৮ জুন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদকে প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর (উপাচার্য) হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেসময় দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আরও ১২ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়।
এদিকে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন হওয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কোথায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে এ নিয়ে কৌতূহল ও আলোচনা শুরু হয়ে যায় জেলার সর্বত্র। নিজ নিজ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের দাবিতে কেউ কেউ মানববন্ধন করেন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য পতিত অথবা এক ফসলি জমি নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হলে সেসময় চার-পাঁচটি স্থানের দাবি তুলেছিল তৎকালীন আওয়ামীলীগের ক্ষমতাশীল জনপ্রতিনিধিসহ জেলা ও উপজেলার নেতারা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর এলাকা নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়ার বিল। এরপর রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে মহাদেবপুর উপজেলার চৌমাসিয়া (নওহাটা) মোড়, পার্শ্ববর্তী বাবলা তলী নামক স্থানে চকচকে বিল ও সদর উপজেলার দিঘলীর (প্রাচীর) বিল এবং বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন বিল।
এরমধ্যে ছাতড়া বিল নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য এক ফসলী কিংবা পতিত জমি দাবি করে ছাতড়ার বিলই উপযুক্ত স্থান বলে দাবি করে সাবেক খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার তার এলাকাতেই হওয়ার পক্ষে ছিলেন।
এদিকে শহরের পাশে দিঘলীর বিলে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান দাবি করে দফায় দফায় মানববন্ধন করেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের একাধিক নেতার নেতৃত্বে এলাকাবাসী। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর পদচারণা হয়েছিল দিঘলীর (প্রাচীর) বিলে এই দাবি তুলে তারা একাধিকবার মানববন্ধন করেন। যদিও সেখানে কারো কারো স্বার্থ ছিল অনেক বেশি।
তবে অনেকে বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য ওই দুই স্থান নির্বাচন হলে বিলের জমি কেনা-বেঁচায় লাভবান হতেন তৎকালীন ক্ষমতাশীলরা। জমি নিয়ে ব্যবসা করতে পারতেন তারা।
অপরদিকে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে মহাদেবপুর উপজেলার নওহাটা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের ব্যাপারে সরব হয়ে একাধিকবার মানববন্ধন করেছিল এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
তবে দুই বছরেও স্থান নির্ধারণ না হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন তৎকালীন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা দায়ি। তাদের স্বার্থের বেড়াজালে ও টানা হেঁচড়ার কারণে আজও স্থায়ী জায়গা পায়নি স্বপ্নের নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়।
নওগাঁ সরকারি কলেজের ইন্টার পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শুধুই নামই শুনতে পাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। জোর দাবি জানাই, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হোক।
এদিকে একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু ও স্থান নির্ধারণ না হওযায় হতাশ শিক্ষাবিদসহ শিক্ষার্থীরা। তাই সর্বশেষ গত রোববার ১৫ ডিসেম্বর নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তি, ক্লাশ ও পরীক্ষাসহ যাবতীয় একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর দাবিতে মানববন্ধন করেছে ছাত্র-জনতা।
এর আগে গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের এক দফার দাবির মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতন হওয়ার পর থেকেই 'নওগাঁ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়' এর নাম পরিবর্তনের জোরালো দাবি জানিয়ে আসছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। যদিও বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করলেও নাম পরিবর্তনে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তারপরও গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী প্রশাসনিক ভবনের সামনে ‘নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা নতুন সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম একজন ফজলে রাব্বী বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো জেলার শিক্ষার মান ও হার অনেক বাড়িয়ে দেয়। কৃষিতে সারা বাংলাদেশে বৃহত্তর নওগাঁর অবদান অন্যতম হলেও এজেলার শিক্ষার হার অন্যান্য জেলার থেকে কিছুটা কম। আমাদের গর্বের বিষয় আমরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি। কিন্তু আগের সরকারের কিছু জনপ্রতিনিধির ব্যক্তি স্বার্থ ও টানা হেঁচড়ার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, আমরা আর কারো ব্যক্তি স্বার্থ বা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টানা হেঁচড়া দেখতে চাইনা।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নওগাঁ সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলিমুর রেজা রানা। তিনি বলেন, তাদের টানা হেঁচড়ার কারণে আজও পূর্ণাঙ্গরুপে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে পারেনি। যেটা আমাদের লজ্জাজনক। তাই আমরা চাইবো দ্রুত উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু করা হোক।
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ শরিফুল ইসলাম খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি যা নওগাঁবাসীর জন্য দু:খজনক। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই গবেষণার একটি ক্ষেত্র। একটি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখে, মান সম্মত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই এখন যাঁরা দ্বায়িত্বে থাকবেন তাঁরা যেন দ্রুত যৌক্তিক স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালুর ব্যবস্থা করেন।
বর্তমানে শহরের বালুডাঙ্গা এলাকায় নওগাঁ মডেল টাউনে একটি ভাড়া বাড়িতে স্বল্প পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর দ্বিতীয় উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে যোগ দিয়েছেন ড. মোহ: হাছানাত আলী।
ভিসি ড. মোহা: হাছানাত আলী বলেন, আমার এখানে ভিসি হিসেবে আসা তখনই আনন্দের হবে যখন নওগাঁবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই বিশ্ববিদ্যালয় দৃশ্যমান করতে পারবো। আমি সেই ভিশন নিয়েই এগুচ্ছি। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপ হিসেবে গত ১৭ অক্টোবর ৬টি বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর জন্য ইউজিসি বরাবর আবেদন করেছি। ২০২৪-২৫ শিক্ষা বর্ষের জন্য যার আসন সংখ্যা চাওয়া হয়েছে ৩০০টি। এছাড়া নওগাঁবাসীর প্রত্যাশা পূরণে গত ১২ নভেম্বর পূর্বের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বিবিদ্যালয় নাম পরিবর্তন করে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণের জন্যও আবেদন করেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নবনিযুক্ত উপাচার্য বলেন, একই সাথে অনুমোদন লাভ করা অন্যান্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। অজানা কারণে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুই হয়নি। অথচ নওগাঁ থেকে সারাদেশের মানুষকে চাল দেয়, খাবার দেয়, আর সেই নওগাঁতে বিশ্ববিদ্যালয় হয়না, শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়না এটা দু:খজনক। সবকিছু এখন নির্ভর করছে ইউজিসি ও সরকারের অনুমোদনের জন্য। যদিও এখনও কোনো পজিটিভ সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। তবে হাল ছেড়ে দিইনি। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ মুঠোফোনে বলেন, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালুর বিষয়ে আলোচনা কমপ্লিট হয়নি। আলেচনা করে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া যেখানে কনো রকম কোর্স চালু হয়নি বা শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি, তাদের বিষয়ে সরকার কি ভাবছে? এটা মাথায় রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিবো। আর সরকার যেটা করবে, ওটাকে আমরা ধারণ করে সিদ্ধান্ত নিবো। তবে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, ড. মোহা: হাছানাত আলী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের (আইবিএ) অধ্যাপক ছিলেন। গত ৬ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে তাকে চার বছরের জন্য ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।