এক যুগে সড়কে ঝরেছে লক্ষাধিক প্রাণ-যাত্রী কল্যাণ সমিতি

বিগত এক যুগে সড়কে ৬৭ হাজার ৮৯০টি দুর্ঘটনায় এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত ও এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি

এক যুগে সড়কে ঝরেছে লক্ষাধিক প্রাণ-যাত্রী কল্যাণ সমিতি

বিগত এক যুগে সড়কে ৬৭ হাজার ৮৯০টি দুর্ঘটনায় এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত ও এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) সকালে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই তথ্য তুলে ধরেন।

মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার আগে দেশে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ পথ হিসেবে নৌ ও রেলপথে ৮০ শতাংশ এবং সড়কে ২০ শতাংশ মানুষের যাতায়াত ছিল। তাই সড়কে দুর্ঘটনা ২০ শতাংশে সীমিত ছিল। স্বাধীনতার পরে দাতা সংস্থার পরামর্শে একের পর এক সড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে বেহিসেবি লুটপাট, সড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, বহুমাত্রিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে একের পর এক নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করে ৮০ শতাংশ মানুষের যাতায়াত সড়কে নিয়ে আসার কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ‘সড়কে এই গণহত্যার’ জন্য সরকারের দুর্নীতি ও ভুলনীতি দায়ী।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর দেশ নানা খাতে অগ্রসর হলেও দাতা সংস্থার পরামর্শে নৌ ও রেলপথ অবহেলিত থেকে গেছে। বরং একের পর এক সড়ক সম্প্রসারণে সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পথচারী অবকাঠামোর অভাব ও উন্নত গণপরিবহনের সংকটে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে এই সেক্টরে দৃশ্যমান অগ্রগতি সম্ভব নয় উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক বলেন, জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে পরিবহন সেক্টর সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে দেশের সাধারণ মানুষের যাতায়াতের ভোগান্তি আরও বাড়বে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উন্নত গণপরিবহন নামানোর পরিবর্তে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন দিয়ে রাস্তায় নামানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে এই প্রক্রিয়ায় অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও নানাবিধ গলদ থাকায় এই কার্যক্রম শুরু করা হলে এক বছরের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর অটোরিক্সার কারণে অচল হয়ে যাবে। তাই এহেন সিদ্ধান্ত থেকে ফেরত এসে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ম্যাস ট্রানজিট (পাতাল মেট্রোরেল) এর ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।

দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, সড়ক পরিবহন খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও কতিপয় দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্যের কারণে সড়কের বিশৃঙ্খলা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, লাইসেন্সবিহীন চালক, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, সড়কে ত্রুটি, চালকের মাদক গ্রহণ, বেপরোয়া গতি, অযোগ্য চালকের হাতে লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্সবিহীন-প্রশিক্ষণহীন চালকের হাতে যানবাহন তুলে দেওয়াসহ নানা কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে আগামী বুধবার (২২ অক্টোবর) নিরাপদ সড়ক দিবস সামনে রেখে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের হাজার হাজার মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষায়, যাতায়াতের ভোগান্তি লাঘবে জরুরিভিত্তিতে ১২ দফা সুপারিশ পেশ করেন তিনি।

সুপারিশগুলো হলো—

১. হারিয়ে যাওয়া নৌ ও রেলপথ সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।

২. চাঁদাবাজি ও অনিয়ম-দুর্নীতি, মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে পরিবহনখাত আপাদমস্তক সংস্কার করতে হবে।

৩. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ম্যাস ট্রানজিট (পাতাল মেট্রোরেল) এর ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল লেনদেনের ভিত্তিতে কমপক্ষে দুটি বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (আলাদা উন্নতমানের বাস লেন) লেন চালু করতে হবে।

৫. সারাদেশে জেলা শহর থেকে উপজেলায় মানসম্পন্ন বাস নামিয়ে যাতায়াতে শক্তিশালী বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।

৬. মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমদানি ও বিপণন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

৭. উন্নত কারিকুলাম তৈরি করে পরিবহন চালকদের রাষ্ট্রের খরচে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৮. উন্নত দেশের আদলে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম ডিজিটাল করতে হবে। ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তুলতে হবে।

৯. সড়ক দুর্ঘটনার মামলা সরকারি উদ্যোগে আমলে নিতে হবে। প্রতিটি হতাহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আওতায় আনতে হবে।

১০. পরিবহন সেক্টরে যাত্রীস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি ফোরামে যাত্রী প্রতিনিধি তথা ভুক্তভোগীর মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১১. সড়ক সেক্টরে আইনের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

১২. সারাদেশে সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের জন্য পৃথক লেন ও নিরাপদ ফুটপাতের ব্যবস্থা করতে হবে।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি শরীফ রফিকুজ্জামান, বারভিডার সভাপতি আবদুল হক, ড্রাইভার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বাদল আহমেদ প্রমুখ।

চাঁপাই প্রেস/সূত্র_ইত্তেফাক