এসিআর আটকে রেখে শিক্ষকদের ভয়ভীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে

নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নাজমুল হাসান ও উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মাহিদুল হাসান।

এসিআর আটকে রেখে শিক্ষকদের ভয়ভীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে

এ.বি.এস রতন স্টাফ রিপোর্টার নওগাঁ : নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নাজমুল হাসান ও উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মাহিদুল হাসান। গত ২২ আগস্ট পদত্যাগপত্রে তিনি লেখেন, আমি অধ্যক্ষ ও উপদাক্ষ পদ হতে পদত্যাগ করলাম। এর পর অভিযুক্ত অধ্যক্ষ নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি । কমিটির প্রধান করা বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রফেসর শওকত আলম মীরকে। গত ৬মার্চ বৃহস্পতিবার সরেজমিনে তদন্ত করতে কলেজে আসেন তদন্ত কমিটি। কিন্তু এর আগেই কিছু শিক্ষকদের নাজমুল হাসানের পক্ষে সাফাই করতে বাধ্য করতে পরিকল্পনা করা হয়। নানা কৌশল এর মাধ্যমে চেষ্টা করে যাতে নাজমুল হাসানের অনিয়মও দুর্নীতি যেন তদন্ত কমিটি না পায়। এজন্য নাজমুল হাসানের পক্ষে নিয়ে শিক্ষকদের নানাভাভে ভয়ভীতি দেখানো হয় হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

অধ্যক্ষের পক্ষে সাফাই করতে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল: অভিযোগ রয়েছে এ পরিকল্পনার সাথে সরাসরি জড়িত কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. মুনিরুজ্জামান। মুনিরুজ্জামান তদন্তে একদিন আগে ৫ মার্চ কলেজের সকল বিভাগীয় প্রধানদের ও কর্মচারিদের নিয়ে দুইটি পৃথক মিটিং এর আহব্বান করেন। এর পর শিক্ষকদের তিনি বলেন, নাজমুল হাসান স্যারের কাছে শিক্ষদের বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) রয়েছে। চলতি বছরের এসিআর কাগজে তিনিই স্বাক্ষর করবেন। তাই নাজমুল হাসান স্যারের পক্ষেই তদন্ত কমিটির কাছে কথা বলতে হবে। নইলে আপনাদের অনেকেরই সমস্যা হবে। যার কারনে অনেক শিক্ষক তদন্ত কমিটির কাছে নাজমুল হাসানের দূনীতির বিষয়ে মুখ খোলেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও শিক্ষক মো. মুনিরুজ্জামান সহ আরও দুই একজন শিক্ষক মিলে পরিকল্পিতভাবে অধ্যক্ষ নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে ১৪ টি অভিযোগ তাদের প্রছন্দের ১৪ জন শিক্ষককে দিয়ে তদন্ত কমিটির নিকট শুনানি করান।

যা বলছেন কলেজের কর্মচারীরা: নাম প্রকাশ না করা শর্তে বেশ কয়েকজন কলেজ এর কর্মচারিরা বলেন, মুনিরুজ্জামান স্যার ৬ তারিখ সকাল সাড়ে ৯টায় আমাদের ডেকে বলেছিলেন যে নাজমুল স্যারের বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে আমরা যেন নেগেটিভ কিছু না বলি। এমনকি নানা মাধ্যমে আমাদের ভয়ভীতিও দেখান। আমরা ছোট পদে কর্মরত রয়েছি তাই আমাদের নাম প্রকাশ করবেননা। তাতে করে আমাদের সমস্যা হতে পারে। নাজমুল স্যারের অনিনিয়ম ও দুর্নীতি যাতে তদন্ত কমিটির কাছে প্রকাশ না পায় তার জন্য মুনিরুজ্জামান স্যারসহ কয়েকজন নানাভাবে চেষ্টা করছেন।

কলেজ শিক্ষকরা যা বলছেন: কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আব্দুল মোতালেবসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানান, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মো. মুনিরুজ্জামান গত ৫তারিখে আমাদের ডাকেন জরুরি মিটিং করবেন বলে। তার তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে নামজুল স্যারের বিপক্ষে কিছু বলা যাবেনা তার কারন স্যারের কাছে আমাদের (শিক্ষদের) বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) রয়েছে। সবমিলে তাতে করে আমাদেরই হয়তো সমস্যা হতে পারে। এভাবেই ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে বোঝায় যে তদন্ত কমিটির কাছে নাজমুল স্যারের ব্যাপারে নেগেটিভ কোন কথা বলা যাবেনা।

যা বলছেন শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক : নাজমুল হাসানকে অনিয়িম ও দুর্নীতি যেন তদন্ত কমিটির কাছে প্রমান না হয় এবং কলেজের শিক্ষকরা যেন মুখ না খোলেন যে জন্য মূল পরিকল্পনাকারী ছিল কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো.মুনিরুজ্জামান। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, নাজমুল হাসান স্যারের পক্ষে তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে আমি কোন শিক্ষক বা কর্মচারিকে ভয়ভীতি বা চাপ প্রদর্শন করিনি। তদন্ত কাজে প্রভাবিত করার জন্য বিন্দু পরিমাণও চেষ্টা করিনি। মিটিং ডেকেছিলাম তদন্তের বিষয়টি সবাইকে অবগত করার জন্য।

যে সব অভিযোগ তোলা হয় নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধ: গত ২২আগষ্ট বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা। নওগাঁ সরকারি কলেজে প্রাঙ্গনে জড়ো হতে থাকে শত-শত শিক্ষার্থী ও অবিভাবকরা। এর কিছুক্ষণ পর অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে অধ্যক্ষ নাজমুল হাসানসহ ৭ শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অধ্যক্ষ ও উপদাক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষকদের উদ্ধার করেন। এর আধা ঘন্টা পরে ওই দুজন নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এদিকে অপর পাঁচ শিক্ষক তিনদিনের মধ্যে পদত্যাগ করবেন বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে আ.লীগ সরকারের পতনের পর কলেজের অধ্যক্ষ এর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও ৬ শিক্ষক তারা নানাভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করে, তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে ক্ষমতার অপব্যবহার করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

তদন্তের বিষয়ে যা জানা গেল: নওগাঁ সরকারি কলেজের ছাত্র প্রতিনিধি মো.নওফেল বলেন, কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্য, এডিপির ফান্ড থেকে টাকা আত্মসাত, শিক্ষার্থীদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং মাসিক বেতন এর নামে শিক্ষার্থীদের থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে কলেজ থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তদন্ত কমিটি গঠণ করা হলেও তদন্ত করে কি প্রতিবেদন দেয়া বা কাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে এসব বিষয়ে জানা নেই। এমনকি তদন্ত কমিটির পক্ষ আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি।

অনিয়ম এর অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর নাজমুল হাসান বলেন, আমি এখানে থাকি তাহলে কিভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করবো বা ভয়ভীতি দেখাবো। এসব অভিযোগ সত্য নয়। এসিআর আমার কাছে ছিল তবে তা আমি ৬তারিখের পর জমা দিয়েছি।

তদন্ত কমিটির প্রধান করা বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রফেসর শওকত আলম মীর বলেন, আমরা ডেকেছিলাম সবাইকে। এদের মধ্যে কেউ এসেছিলেন আবার কেউ আসেননি। ১৪টি অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৪জন শিক্ষক-কর্মচারির বাহিরেও অনেকেই আলাদাভাবে ডেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) ইস্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের চাপে রাখার বিষয়ে খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে আমরা চেষ্টা করছি সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার।