প্রধান উপদেষ্টাকে এখন কঠোর হতেই হবে

বাংলাদেশের জন্য সামনের কয়েকটা দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান

প্রধান উপদেষ্টাকে এখন কঠোর হতেই হবে

বাংলাদেশের জন্য সামনের কয়েকটা দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেদিনটি খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব, বড়দিন। ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন।

তার দুই দিন পরই ২০২৫ সালকে বিদায় জানানো হবে। এসব অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটবে। ষড়যন্ত্রকারীরা ওত পেতে থাকবে। নাশকতার ছক কাটবে।

একটা কিছু ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে। সেজন্য সরকারকে প্রতিটি অনুষ্ঠানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ সময়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে তা হবে এ সরকারের জন্য এক বড় বিপর্যয়। এর প্রভাব পড়বে ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে।

অনেকে একটু আগ বাড়িয়ে বলেন, এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ না হলে সরকারের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। কিছুদিন ধরেই দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। জনগণের অসহায়ত্ব স্পষ্ট। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। কান পাতলেই শোনা যায়, সরকারকে নিয়ে নানা সমালোচনা।

সাধারণ মানুষ মনে করে, সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থার উন্নতি না হলে কীভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব হবে, এ প্রশ্ন এখন সবার। নির্বাচনি প্রচারণায় ভয়াবহ সহিংসতার আশঙ্কা করছেন অনেকে।

শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে যে তাণ্ডব হয়েছে, তা মোকাবিলায় সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা সবাই প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার। এ নৃশংস ঘটনার অবশ্যই প্রতিবাদ হওয়া দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে অন্য মব সন্ত্রাসেরও প্রতিবাদ সমানভাবে করা উচিত। এখন যেসব সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার, গত দেড় বছর তাঁরা নীরব ছিলেন কেন?

শুরু থেকে জাতির বিবেকরা যদি মবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাহলে মব সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তরা আজ এত বেপরোয়া হতে পারত না। তখন সবাই তামাশা দেখেছি, নীরব থেকেছি। সেই জন্যই মব বাহিনী এখন দানবে পরিণত হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর শুধু প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নয়, ছায়ানট এবং উদীচী অফিসেও হামলা হয়েছে। কিন্তু দুটি পত্রিকা নিয়ে যত কথা হয়েছে ছায়ানট বা উদীচী নিয়ে ততটা প্রতিবাদ হচ্ছে না। সমসাময়িক সময়ে কয়েকটি পৈশাচিক ঘটনা গোটা দেশকে স্তব্ধ করেছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের নিহত দিপু চন্দ্র দাসকে হত্যার পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকায় লোকজন বিক্ষোভ করে তাঁর লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়। খুলনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা মো. মোতালেব শিকদার গত সোমবার গুলিবিদ্ধ হন। এ রকম ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন, দেশের কোথাও না কোথাও। পুলিশ বাহিনী যেন অসহায়। তারাও এখন সংঘবদ্ধ মব সন্ত্রাসীদের ভয় পায়।

আশার কথা, দেরিতে হলেও মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। গত রবিবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হবে। বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন, আসন্ন বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে গৃহীত নিরাপত্তাসংক্রান্ত পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এ ছাড়াও ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তার ও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। ওসমান হাদি হত্যায় জড়িত এবং অন্যান্য বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা।

কিন্তু সচেতন মহল মনে করে, কথা তো অনেক হলো, এবার কাজ করে দেখানোর সময়। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টা শান্তির বাণী শোনাচ্ছেন। বারবার আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে অনুরোধ করছেন। সবাইকে সংযত থাকতে বলছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? যারা দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় তাদের কাছে এসব অনুরোধ মূল্যহীন। সুন্দর কথায় তাদের মন গলে না, বন্ধ হয় না অপকর্ম। সরকারের শান্তির আহ্বানকে দুর্বৃত্তরা দুর্বলতা মনে করেন। সবচেয়ে বড় কথা, এতদিন ধরে মবকারীদের প্রতি সরকারের বিভিন্ন মহলের এক ধরনের সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই মবকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মবের কাছে সরকারের অসহায় আত্মসমর্পণও আমরা দেখেছি। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এ অপশক্তি এখন রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রের আইনকানুনকে এরা বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। নির্বাচনের আগে যদি এই দানবদের বোতলবন্দি না করা যায় তাহলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে চরমভাবে। দিন যতই যাচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এই উদ্বেগ নিয়ে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য বারবার বলছেন, আগামী নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। সর্বকালের সেরা নির্বাচন। গত সোমবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত সার্জিও গরের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতি অধীর আগ্রহে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে; যা স্বৈরাচারী শাসনামলে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’ প্রধান উপদেষ্টা যখন মার্কিন দূতকে আশ্বস্ত করেছিলেন ঠিক তখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের বিষয়ে গণভোটের প্রচারে ১০টি ভোটের গাড়ি ‘সুপার ক্যারাভান’ যাত্রা করে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে সুপার ক্যারাভানের যাত্রা হয়। ভোটের গাড়ির উদ্বোধন করেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সামনে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ওপর গণভোট। নির্বাচন ও গণভোট সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দেবে ভোটের গাড়ি সুপার ক্যারাভান। ১০টি ভোটের গাড়ি দেশের ৬৪ জেলা ও ৩০০ উপজেলায় ঘুরে নির্বাচন, গণভোট এবং ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবে এবং গণতন্ত্রের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। গণভোটে হ্যাঁ ভোট দিতে বলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে আপনি আরও একটি ভোট দেবেন। জুলাই সনদে ভোট দেবেন। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে এ সনদ তৈরি হয়েছে। এ সনদ দেশের মানুষ পছন্দ করলে দেশ আগামী বহু বছরের জন্য নিরাপদে চলবে। আপনি যদি এ সনদ সমর্থন করেন তবে গণভোটে অবশ্যই হ্যাঁ ভোট দিন। তিনি আরও বলেন, ‘চলুন, আমরা সবাই মিলে এই গণতান্ত্রিক যাত্রা সফল করি। চলুন, ভোট দিই নিজের জন্য, দেশের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, নতুন পৃথিবীর জন্য।

প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিকতা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ড. ইউনূস নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই তারা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। এ অবস্থায় এদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। এখনই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিলে নির্বাচনের গাড়ি মাঝপথেই ডাকাতের কবলে পড়বে।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।