ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা
অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের (তৎকালীন মালদহ জেলা) শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ভাষাসৈনিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা, এক সময়ের বলিষ্ঠ বাম রাজনীতিক, পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর ৪র্থ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রানীহাটি বাজার ঈদগাহ ময়দানে।
শনিবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা থেকে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স তাঁর গ্রামে এসে পৌঁছায়। পরে সকাল ৯টার দিকে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার পূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ কৃতী সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান- চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন ও পুলিশ সুপার মো. ছাইদুল হাসান। এসময় শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ,এফ,এম, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকশ দল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করে।
শেষবারের মতো গুণী এ মানুষটিকে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন পাশর্^বর্তী গ্রামের আরেক কৃতী সন্তান বিচারপতি এমদাদুল হক।
অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর ছোট মেয়ে ডানা নাজলী, জামাতা সাহিনুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অনেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্মৃতিচারণকালে সবার কথায় উঠে আসে অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর দেশপ্রেম, গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তাঁর কর্মময় জীবনের সততার কথা।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর মরদেহ নেয়া হয় রাজশাহীতে। সেখানে রাজশাহী সিটি মেয়র, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জানাজায় অংশ নেন। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও জানাজা শেষে মরদেহ ঢাকায় নেয়া হয়।
এর আগে প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয় নিউ বেইলি রোডে মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টের নিজ বাসায়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর কর্মস্থল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। জানাজায় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার, আন্তর্জাতিক ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর মো. মুখলেসুর রহমান বাদল, রেজিস্টার ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ ও তদন্ত সংস্থার প্রধান এম সানাউল হক উপস্থিত ছিলেন।
এসময় জানাজায় শরিক হন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম ও সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা।
অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের (তৎকালীন মালদহ জেলা) শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আফতাব উদ্দিন আহমদ ছিলেন জেলা রেজিস্টার। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে টিপু দ্বিতীয়। তিনি কালিয়াচর বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক ও রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। একই কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্নের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলন তাঁর নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
গোলাম আরিফ টিপু ১৯৫৮ সালে একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একাধিকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।