চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলীনগরে কালের সাক্ষী ভূতপুকুর ভরাট করছে ভূমিদস্যুরা
গত সোমবার ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত
ক্রাইম রিপোর্টার:গ্রামের নাম ভূতপুকুর। চারিদিকে বসতবাড়ি, মাঝখানে সড়কের পাশে বিশাল একটি পুকুর। প্রায় ৪০ বছর ধরে অস্তিত্ব রয়েছে এই পুকুরের। নানারকম কল্পকাহিনী ও রোমাঞ্চকর গল্প রয়েছে এই ভূতপুকুরকে ঘিরে। কথিত আছে,পুকুরের মধ্যখানে সোনার চাবি, মসোনার হাড়ি পাওয়া গেছে প্রায় ৪ দশক আগে। স্থানীয়দের বিশ্বাস,পুকুরে বসবাস ছিল অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এমন অশরীরী শক্তির। এসব অলৌকিক গল্পের কারণেই পুকুরের নাম ভূতপুকুর। আর পুকুরের নামেই গ্রামের নামও হয় ভূতপুকুর। শুধু গল্প কাহিনীতেই নয়,ভূতপুকুর নাম রয়েছে স্থানীয়দের জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্কুল-কলেজের সনদেও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের আলীনগর এলাকায় সেই ভূতপুকুরে নজর পড়েছে ভূমিদস্যুদের। অস্তিত্ব বিলীনের পথে এখন পুকুরটি। আইন অমান্য করে ফসলী জমির টপ সয়েল বা উপরিভাগ কেটে এনে বিশাল পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করেই রাতের অন্ধকারে চলছে ভরাট।
ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ড করা পুকুরগুলো জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করার নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। পরিবেশ আইন-১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর বিধান অনুসারে যেকোনো জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ এবং ব্যক্তিগত পুকুর হলেও তা জলাধারের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা ভরাট করা যাবে না।
কিন্তু আইন অমান্য করেই সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে ভূতপুকুর ভরাট। ফসলী জমি কেটে পুকুর ভরাটের অপরাধে গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপরেও বন্ধ হয়নি মাটি কাটা ও সেই মাটি দিয়ে পুকুর ভরাট।
পুকুর পাশেই বাড়ি মো. জিয়ার। তিনি বলেন, গত ৪০ বছর ধরে আমরা এই পুকুর দেখছি। এই গ্রামে মোট তিনটি পুকুর রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত পুকুর এটি। ৪০ বছর আগে সর্বশেষ এই পুকুরের পানি শুকিয়েছিল। এরপর কখনো শুকায়নি। সে সময়ে একবার খুড়তে গিয়ে সোনার চাবি পাওয়া গিয়েছিল বলে শুনেছি। আমি নিজেই সোনার হাড়ি দেখেছি এই পুকুরে।
স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ ইয়ার আলী বলেন, পুকুরকে ঘিরে নানারকম অলৌকিক গল্প ও অশরীরী শক্তির প্রদর্শন দেখেই এই পুকুরের নামে গ্রামের নাম হয় ভূতপুকুর। এই এলাকায় যখন বাড়িঘর কম ছিল, ১৫-২০ বছর আগে এই পুকুরের ধার দিয়ে সন্ধ্যার পর মানুষ চলাফেরা করতে ভয় পেত। যদিও কারো কোনো ক্ষতি হয়নি কখনো। তবে পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অলৌকিক অনেক কিছু দেখা যেত।
স্কুলশিক্ষক আরিফুল ইসলাম বলেন,জেলা শহরের খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ভূতপুকুর। আশেপাশের সকল খাল-ডোবা ভরাট হয়ে ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। তবে ভূতপুকুরটি আমরা দীর্ঘদিন ধরে পানি ধরে রাখতে দেখছি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে সেই বিশাল পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। জেলা শহরে সারারাত ধরে তারা এমন ভরাটের কাজ করলেও প্রশাসনের কোনো তদারকি বা ব্যবস্থা নেয়া নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুবক বলেন, শুনেছি গত সোমবার ফসলী জমি কাটা ও পুকুর ভরাটের অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। কিন্তু জরিমানার দিনেও বন্ধ হয়নি ভরাট ও মাটি কাটার কাজ। তার মানে তারা অনেক প্রভাবশালী। তাই প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অপরাধ করছে। এই পুকুরটি বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কখনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কী হবে? পুকুর তৈরিতে যেমন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তেমনি ভরাট করারও যাবে না। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন।
জানা যায়,গত দুই সপ্তাহ ধরে সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের সল্লা এলাকায় ফসলী জমির টপ সয়েল বা মাটি কাটছে মাটিখেকোরা। সন্ধ্যা নামলেই এসব মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলা শহরের ভূতপুকুর এলাকায় থাকা সেই বিশাল পুকুর ভরাট করতে। ২৫-৩০টি ট্রাক্টরে করে এসব মাটি পরিবহন করতে গিয়ে নষ্ট করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং এলজিইডির পিচঢালা রাস্তা।
এছাড়া সড়কের উপর পড়ে থাকা মাটিতে শীত ও বৃষ্টি পড়ে তৈরি হয় কাদা। ফলে যানবাহন চলাচলেও দেখা দেয় সমস্যা। হরহামেশাই ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা। ধুলাবালির জ্বালায় অতিষ্ঠ সড়কের পাশে থাকা বাসিন্দা ও দোকানদাররা। তাদের দাবি, দ্রুত বন্ধ করা হোক এমন অবৈধ কর্মকাণ্ড।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গায় ফসলী জমি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন রেজাউল করিম নামের এক ব্যক্তি। এই মাটি নিয়ে এসে পুকুর ভরাট করেন আরেক আব্দুস সালাম। জানা যায়, এসব পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এ নিয়ে রেজাউল বলেন,জরিমানা করলে কী করব? এর আগেও জরিমানা করেছে। কিন্তু আমাদের কাজ চলমান থাকে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব করতে হয়।
পুকুর ভরাটের মূলহোতা আব্দুস সালাম বলেন, জরিমানা করলেও কিছু করার নাই। এভাবেই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ফসলী জমির টপ সয়েল কাটা ও পুকুর ভরাট বেআইনি, তা জানেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রশাসন অভিযান করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করার দিনেও আমরা গাড়ি চালিয়েছি। জেলা শহরে এতো বড় কাজ এমনি এমনি কি আর হয়? সব পক্ষকে ম্যানেজ করেই করতে হয়।
উত্তরাধিকার সূত্রে পুকুরের অন্যতম অংশীদার মো. রকি জানান, জরিমানা বা পুকুর ভরাট আইনানুগ কি না তা আমার জানা নেই। তবে আমরা আব্দুস সালামকে পুকুর বাইনামা করে দিয়েছি, সে ভরাট করে বিক্রি করে টাকা দিবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীরা জানান, প্রকাশ্যে এসব ফসলি জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল। ফসলি জমির মাটি কেটে ভরাট করছে পুকুর, ডোবা-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়। এভাবেই তিন ফসলি জমির বুক চিরে ছুটে চলছে মাটি ভরাট করা ট্রাক্টর। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন ফসলী জমিতে এখন চলছে মাটিকাটার মহোৎসব। তিন ফসলি কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে পতিত ভূমিতে। এতে দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে, বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত।
বালুগ্রাম এলাকার আমজাদ হোসেন জানান, যেই জমির উপরিভাগে ধান বোনা হতো, সে জমিতে এখন বিশাল আকারের সারি সারি গর্ত। এছাড়াও মাটি পরিবহনে ভারি ট্রাক, ট্রাক্টর ব্যবহারে গ্রামীণ সড়ক হচ্ছে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। আইন অমান্য করে এমনি কর্মকাণ্ড চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়।
তরিকুল ইসলাম নামের এক উদ্যোক্তা বলেন, অতি লোভে পড়ে আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন একশ্রেণির জমির মালিক। খনিজ ও জৈব উপাদান বিশেষ করে হিউমাস (জৈব কণা) সমৃদ্ধ মাটির ওই অংশ তুলে ফেলার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। কৃষিবিদরা জানিয়েছেন, এর ফলে কয়েক বছর ওইসব জমিতে ফসলের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হবে না। ফসলি জমির মাটি দিয়ে পুকুর, জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। এসব আইনের লঙ্ঘন।
১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পুনরায় কাজটি করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আর ১০ বছরের কারাদণ্ড।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আঞ্জুমান সুলতানা বলেন, গত সোমবার ফসলী জমিতে মাটি কাটার কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। পাশাপাশি পরবর্তীতে এমন কাজ না করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুনরায় মাটি কাটার তথ্য জানা নেই। তবে আবারো মাটি কাটলে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে সদর উপজেলা এসিল্যান্ডকে সরেজমিনে পাঠানো হয় এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। কিন্তু মোবাইল কোর্টের পরেও একই কাজ করলে এবার কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।