জনগণের গনতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা রাজনৈতিক দলের অপচেষ্টা
২০২৪ সালে বাঙালি জাতির নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর বছর ছিলো এটি বাঙালি জাতির জন্য। এই বছরে আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নতুনভাবে চিনলাম।
তজিবুর রহমান রংপুর প্রতিনিধিঃ২০২৪ সালে বাঙালি জাতির নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর বছর ছিলো এটি বাঙালি জাতির জন্য। এই বছরে আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নতুনভাবে চিনলাম। কারো স্বৈরাচারী মনোভাবকে যে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে তার আসন থেকে ছিটকে ফেলে দেওয়া যায় তা আমাদের তরুণ প্রজন্ম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। প্রথাগত রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র সমাজ আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছে এ বছরে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
বহু বছর ধরে আমাদের সেকেলে রাজনৈতিক দলগুলো তথাকথিত নিয়মে অনেকবার চেষ্টা করেও যে কাজে সফল হতে পারেনি তার শুভ সূচনা হয়েছে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন ছিলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সূচনাগার। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও কেন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ সহ ৫৬ শতাংশ কোটা বহাল থাকবে তা নিয়ে ছাত্র সমাজের মধ্যে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে ।শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার বুঝে নিতেই মাঠে নেমে পড়ে এবং শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। সারা দেশের সমস্ত স্কুল -কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে পড়ে । প্রতিদিন শুরু হয় নতুন নতুন কর্মসূচি। গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পুরাতন ধারার রাজনৈতিক দল বেছে নেয় পরাতন পথ। দমন-নিপীড়নের পথ। যা এবার ছাত্র সমাজসহ দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে বিদ্দেশ তৈরি করে ।পাহাড়ী ঢলের মতো মানুষ নেমে পড়ে রাজপথে এই সরকারের বিরুদ্ধে । সরকার যত কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত নেয় জনগণ যেন আরো শ্রাবনের বর্ষার মতো রাস্তায় নামতে থাকে । তারপর চলে আসে এক দফ আন্দোলন।
আমাদের দেশের জনগনের গণতন্ত্র রক্ষার্থে বহুবার প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু হয় আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতনের মাধ্যমে। তারপর ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের একই পথ বেচে নিলে বাঙালি জাতি তাকে রুখে দিতে ঝাপিড়ে পড়ে যুদ্ধে। যা আমাদের সব সময় অণূপ্রেরণা দিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশে গণতন্ত্র আদায়ের চেয়ে রক্ষা করা খুব বেশি কঠীন হয়ে পড়ে সব সময়। ৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যখন দেশটা কালো সকুনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তার কিছু বছর পরেই আবার আগমন ঘটে স্বৈরাশাসক এরশাদ আমল। এরশাদ সরকারকে হটাতেই জনগণ আবার একযোগে রাস্তায় নেমে পড়ে সব বাধা ব্যবধান ভুলে। কিন্তু তাতেও কি আমরা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা করতে পেরেছি? এর কিছু বছর পরেই আবার শুরু হয় শেখ হাসিনার স্বৈরাচারিতা মনোভাব। গণতন্ত্র রক্ষার্থে ব্যর্থ হয়ে আমরা আবার পড়ে যায় এক স্বৈরাতন্ত্রের কবলে।
পৃথিবীর কোনো দেশকে যুদ্ধ করে স্বাধীন করার পরে আবার গণতন্ত্র রক্ষা করতে এতোবার জীবন দেওয়া লাগছে তা নজীরবিহীন।আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় এসেছে তারা গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে স্বৈরাতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। তারা ক্ষমতায় জোরপূর্বক বসে থাকার জন্য গণতন্ত্রের কবর দিয়েছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় ক্ষমতায় নিজেকে পাকাপোক্ত করার তোড়ঝোড়। তার নেতা কর্মীদের সর্বোচ্ছ ক্ষমতা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় আসনে। নয় সালে জনগনের ভোটে নর্বাচিত সরকার যে ক্ষমতায় এসে ঘোল পাল্টাতে শুরু করবে তা ছিল ধারণার বাইরে। তারা জনগনকে শত্রু ভাবতে শুরু করে । এরপর ২০১৪ এর এক তরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতে দেওয়া এবং সর্বশেষ অবৈধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেকে বৈধ করে ১৭ বছর ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এক দলীয় শাসনের ফলে কোনো রাজনৈতিক দলই আর মাথা তুলে দাড়াতে পারেনি ।পুরাতন আমলের সব দলই তখন পুরাতন পদ্ধতিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও কোনো দল তাতে সফল হয়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ ,র্যাব, ডিবিসহ সকলবাহিনীকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে শেখ হাসিনা সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে বিদেশে পাচার করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজীতে ছিল লাগামহীন ভাব। যেন কারোর কিছু বলার নেই।
কিন্তু এতোবড় একটা আন্দোলনের পরে একটা সরকারের পালিয়ে যাওয়ার পরেও আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে ? আমাদের দেশের রাজনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি ৫ আগস্টের পরে? উত্তর হলো ‘না’ । এ যেন সেই নতুন খামে পুরোনো চিঠি । বরং দেশের রাজনৈতিক চিত্র আরো ভয়াবহ রূপে উঠে এসেছে আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে। যেন স্বৈরাচার রাজনৈতিক দলটি চলে যাওয়ার পর অন্য দলের উপর দায়ভার দিয়ে গেছে। আমরা ইদানিং প্রায়ই গণমাধ্যমগুলোতে দেখি বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা কর্মীদের চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বসহ নানান অপকর্ম । প্রচলিত আছে যে পুরাতন এই রাজনৈতিক দলগুলোই আগামীতে সরকার গঠন করবে। তাই প্রশাসন থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছেনা এসবের বিরুদ্ধে। বোঝা যাচ্ছে যে আমরা পূর্বদিনের পথেই এখনো হাটতেছি। অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বললেও আমরা তার কোনো সুফল দেখতে পাচ্ছিনা। আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা হচ্ছিলো তা প্রায় বিফলের পথে।
আমাদের পুরাতন ধারার রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সেই ব্যানার ট্রেন্ডের রাজনীতি ছাড়তে পারেনি। অতীতে যারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছে তাদের করূণ পরিণতি আমরা দেখছি । কিন্তু তা থেকেও যেন আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার উপর দিয়ে এতো বড় ঝড় বয়ে গেলেও আমারা এর ফসল ঘরে তোলা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। আমরা সবাইকে দলীয়ভাবে গ্রহণ করি এখনো। আমরা মানুষকে বিচারের দাড়িপাল্লা হিসাবে ব্যবহার করছি এই দলীয় পরিচয়কে । যার দল বড় এবং সরকার গঠন করবে সে যেন মহারাজা হয়ে উঠছে আমাদের কাছে। রাজনৈতিক ধারার ব্যাপক পরিবর্তন না হলে বা ট্রেন্ডি রাজনীতি পরিবর্তন না হলে আমাদের দেশে কোনো দিনই গণতন্ত্র রক্ষা হবে না । আমাদের সকলকে সকলের রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে বিচার বিবেচনা করতে হবে। সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যে দলই ভবিষ্যতে সরকার গঠন করবে তাদের করনীয় হবে বিরোধী দল বা ছোট সকল দলের রাজনৈতিক চর্চার পথ সুগম রাখা।প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ সুষ্ঠ নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সব থেকে বেশি সাহায্য করবে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে। আমরা যেন সকলে দল মত নির্বিশেষে একই পরিচয়ে বাচতে পারি যে আমরা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নাগরিক।